
ইসলাম দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করেনি কেন?
প্রশ্ন : ইসলাম ক্রীতদাসকে আজাদ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে ঠিক; কিন্তু পরিপূর্ণ নিষিদ্ধ করেনি কেন? জানতে চাই!
উত্তর :
প্রথম কথা হলো, শরীয়তে কোনো জিনিস কেন হালাল হলো, ওটা কেন হারাম হলো; এটা এমন হলো কেন, ওটা কেন এমন হয়নি- এ জাতীয় প্রশ্ন করা অবান্তর। একজন বান্দার উচিত, কোনো প্রশ্ন ছাড়াই শরীয়তরূপে প্রমাণিত সব কিছু গ্রহণ করে নেওয়া। চাই সেটা তার বুঝে আসুক বা না আসুক। এটাকে ‘আবদিয়াত’ বলে। এ নিঃশর্ত আবদিয়াতই হলো কালিমার দাবী।
এর অর্থ নয় যে, শরীয়তের বিধানগুলো অযৌক্তিক বা স্বভাববিরোধী, নাউযুবিল্লাহ। বরং সবগুলোর পেছনে কোনো না কোনো হেকমত ও যুক্তি লুকায়িত রয়েছে। এর কতেক তো আল্লাহ ও রাসূল উল্লেখ করেছেন। কতেক তারা উল্লেখ করেননি ঠিকই, কিন্তু আল্লাহ কোনো প্রিয় প্রাজ্ঞ বান্দা উল্লেখ করেছেন। কতেক এমন, যা একটু চিন্তা করলে সুস্থচিন্তার মানুষ বুঝেতে পারবে। কতেক বিষয়ের হেকমত আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না।
দ্বিতীয় কথা হলো,
দাসপ্রথা প্রাচীনকাল থেকেই মানবসমাজে প্রচলিত ছিল, এটা ইসলামকর্তৃক প্রবর্তিত নয়। বরং ইসলাম এটাকে অমূল সংস্কার করেছে। এ সংস্কারনীতির অন্যতম হলো- যুদ্ধোত্তর পরাজিত পক্ষের লোকদের ছাড়া সাথারণ কোনো স্বাধীন মানুষকে ক্রীতদাসে পরিণত করা যাবে না। করলে সেটা কার্যকর হবে না। প্রাচীনকাল থেকে মানব সমাজে জুয়ায় হেরে গেলে পরাজিতকে গোলাম বানানো, দেনাপরিশোধে অক্ষম হলে দেনাদারকে গোলাম বানানো, জোরপূর্বক ধরে নিয়ে গোলাম বানানো ইত্যাদি প্রচলিত ছিল। ইসলাম সবগুলোকে বন্ধ করে মাত্র দাস বানানোর একটি পন্থাকেই স্বীকৃতি দিয়েছে। সেটা হলো, যুদ্ধোত্তর পরাজিতকেই কেবল গোলাম বানানো যাবে; অন্য কাউকে নয়। তাও এটি বাধ্যতামূলক নয়। বরং অপশোনাল। ইচ্ছে করলে গোলামে পরিণত করতে পারে, ইচ্ছে করলে আযাদ করে দিতে পারে। তায়েফের যুদ্ধ শেষে যুদ্ধবন্দীদেরকে গোলাম হিসাবে বন্টন করে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই নবীজি সা. প্রাপ্ত গোলামদেরকে সাথে সাথে মুক্ত করে দেন। নবীজির দেখাদেখি বহু সাহাবীও ওদের মুক্ত করে দেন। বন্দীরা আনন্দে হৈ হৈ করতে করতে বেরিয়ে পড়ে।
ইসলাম পুরাতন গোলামদের মধ্যে তাদেরকে আযাদ করা, অথবা বেচাকেনা করার অপশন খোলা রেখেছে। আর নতুন করে গোলাম বানানোর ক্ষেত্রে মাত্র একটি পথই খোলা রেখেছে।
কেন এটি খোলা রেখেছে? কেন পূর্ণ নিষিদ্ধ করেনি? এটা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ।
এ ব্যাপারে হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ. সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন। ‘আশরাফুল জওয়াব’ কিতাবে যে ব্যাখ্যা তাঁর বরাতে উল্লেখ রয়েছে, তার সারসংক্ষেপ মোটামোটি নিম্নরূপ :
কোনো বাহিনী যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পরাজিত শক্তির ব্যাপারে সম্ভাব্য কতগুলো অপশন হতে পারে।
(১) সবাইকে গণহারে ছেড়ে দেওয়া।
এটা কোনো বিবেকবান বিজয়ী গ্রহণ করতে পারে না। সবাইকে ছেড়ে দেওয়া মানে দুশমনদেরকে আবার যুদ্ধ করার সুযোগ করে দেওয়া। এটা যে একটি আত্মঘাতি অপশন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
২) সবাইকে হত্যা করা। যেমনটি বিজয়ী কুফরী শক্তি বহু দেশে করেছে। ইসলামের শত্রুরা মুসলিমদের সাথে বহু দেশে এমন নিষ্ঠুর আচরণ করেছে, ইতিহাস যার স্বাক্ষী। ইসলামও যদি নীতিগতভাবে এটি গ্রহণ করতো, তা হলে শত্রুরা আরও বেশি সমালোচনার সুযোগ পেতো, যেমন এখন তার দাসনীতি নিয়ে করে থাকে। ইসলাম নিরীহ নিরস্ত্র জনগণকে হত্যা করা সমর্থন করে না।
৩) সবাইকে বন্দী করা। এটি উপরের দুটি তুলনায় বাহ্যত ভালো মনে হলেও চুড়ান্ত পরিণামে ভালো নয়। কারণ, বন্দী করা ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর বাড়তি চাপ। এদের রাখার জন্য কয়েদখানা তৈরি করা, ওদের খাবারদাবার ও ঔষধ সরবরাহ করা ব্যয়বহুল, যাতে রাষ্ট্রের কোনো লাভ নেই। কখনো কখনো লক্ষ লক্ষ মানুষ পরাজিত হয়। এদের বন্দী করে রাখা কতটা কঠিন বা অসম্ভব, তা সহজে অনুমেয়।
সবচে বড় কথা হলো, বন্দী করার মধ্যে বন্দীদের স্বাধীন জীবনযাপন ব্যহত হয়। একটি বদ্ধপরিবেশে জীবনযাপন করতে হয়। শিক্ষাদীক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। যা প্রত্যেকে জন্য মৌলিক অধিকার। এটা যদি আজীবনের জন্য করা হয়, তা হলে তা কত কঠিন ও কষ্টকর।
৪) বাকী রইল গোলাম বানানো। এটা যে উপরুক্ত তিন অপশন থেকে শ্রেয়তর, তা পরিস্কার। এর দ্বারা গণহত্যা থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। গণহারে ছেড়ে দেওয়ার নির্বুদ্ধিতা ও তার ক্ষতি থেকে মুসলমানেরা বেঁচে যায়। বন্দী করে রাখার যেসব অসুবিধা, তা থেকে লোকটি এবং রাষ্ট্র বেঁচে যায়। বন্দী জীবনের কষ্ট ও অসুবিধা থেকে মুক্ত হয়ে অনেকটা স্বাধীন জীবন লাভ করে। যেখানে সে বাইরে চলাফেরা, ব্যবসা-বানিজ্য, শিক্ষাদীক্ষা অর্জন, সফর-ভ্রমণ সবই করতে পারে। এতে সে বহুগুণে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার সুযোগ লাভ করে। সেবার মাধ্যমে স্বীয় মালিককে সন্তুষ্ট করে, অথবা মুকাতাবা তথা চুক্তির মাধ্যমে নিজেকে মুক্ত করে নিতে পারে, যা অন্য অপশনগুলোতে সম্ভব নয়। অধীনস্ততা ছাড়া এখানে তেমন কোনো অসুবিধা নেই; যেখানে তার যাবতীয় মৌলিক ও মানবিক অধিকার ঠিক রাখার জন্য ইসলাম মালিককে নির্দেশ দিয়েছে। মালিকের মতো যেন জীবনমান সমান হয়, তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে।
বস্তুত ইসলাম যে ধারার ক্রীতদাসনীতির অনুমোদন করেছে, সেটা বর্তমানের শ্রমদাস থেকে বহুক্ষেত্রে ভালো ছিল। মনিবের অধিনে থেকে বা পরে শিক্ষা ও যোগ্যতা অর্জন করে বহু জ্ঞানী-বিজ্ঞানী, আলিম, ফকীহ, মুফাসসির, মুফতী, মুহাদ্দিস, লেখক, চিন্তাবিদ, ওলী সৃষ্টি হয়েছেন; যা ইতিহাসে বিরল ঘটনা। ইসলামের ইতিহাস এমন প্রতিভাবানদের কীর্তিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। শুধু তাই নয়, মাওয়ালীদের বংশপরম্পরায় দেশ শাসন করা, রাজা-বাদশা হওয়া, বিচারক, সেনাপতি হওয়াসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করার বিষ্ময়কর ইতিহাস ইসলামের দাসনীতির বদৌলতে সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বে দাসপ্রথা বিলুপ্তিতে ইসলামের অবদান অসামান্য। যদিও শাস্ত্রগতভাবে দাসপ্রথা পুরোপুরি বাতিল ঘোষণা করা হয়নি।
মোটকথা, ইসলামের সংস্কারকৃত দাসপ্রথা যুদ্ধবন্দীদের সাথে অন্য যেকোনো আচরণের চেয়ে শ্রেয়। এতে আপত্তি বা অভিযোগ করা বিবেকানদের জন্য শোভনীয় নয়।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
মুহাম্মাদ সাইফুদ্দীন গাযী
দারুল হিকমাহ
০৭/০৯/২১